রঞ্জনা নামের বৃক্ষ

Shafiul
প্রতিবেদন প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৪ | সময়ঃ ০৫:০১
photo

অপরাধ সূত্র :

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এক গাঁয়ে’ কবিতায় রয়েছে,

‘আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা,

আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা,

আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে—

আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা’

রবিঠাকুরের ‘রঞ্জনা’ একটি মেয়ে। রঞ্জনা নামের একটি বৃক্ষও কিন্তু রয়েছে। রঞ্জক বা রং এ গাছ থেকে পাওয়া যায় বলে এর নাম রঞ্জনা।

 

ময়মনসিংহ শহরের ব্রহ্মপুত্র নদতীরবর্তী কাছারিঘাট এলাকা ও জয়নুল আবেদিন উদ্যান ভোর থেকে সারা দিন মুখর থাকে মানুষের পদচারণে। স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ ভোরবেলায় হাঁটতে যান সেখানে। নির্বাচন কমিশন অফিসের পূর্ব দিকে বালুঘাটের ওপরে রয়েছে কৃষ্ণচূড়া, গামারি, উদাল, কদম ও সোনালুগাছ। গাছের নিচে রয়েছে চা আর শিঙাড়া–পুরির কয়েকটি দোকান। ওখানে দুটি রঞ্জনাগাছও রয়েছে। উত্তর দিকে তাকালে নদীর চর, তারপর শীতে শুকিয়ে যাওয়া শীর্ণ নদ চোখে পড়ে। আর ওপারে চোখে পড়ে সবুজ মাঠ, গাছপালা ও লোকালয়।

 

৯ জানুয়ারি সকালে জয়নুল উদ্যানে হেঁটে কাছারিঘাট হয়ে ফিরছিলাম। শীতের সকালে ব্রহ্মপুত্রের ঠান্ডা বাতাস লাগছিল গায়ে। গাছপালার গায়ে লেগে ছিল শিশিরকণা। রঞ্জনাগাছের নিচের একটি চায়ের দোকানে গেলাম চা খেতে। দেখলাম, রঞ্জনাগাছ দুটির ডালে শিমজাতীয় ফল ফেটে লাল বীজ তার গায়ে লেগে রয়েছে। একটি গাছের ডালে দেখলাম, একই পুষ্পমঞ্জরিতে শুকিয়ে ফেটে যাওয়া ফল এবং নতুন সবুজ ফল পাশাপাশি রয়েছে। কিছু বীজ পড়ে আছে মাটিতে।

 

রঞ্জনা মাঝারি আকারের পাতাঝরা গাছ। পাতা দ্বিপক্ষল, গাঢ় সবুজ, পত্রক ২ থেকে ৩ সেন্টিমিটার লম্বা, বসন্তে নতুন পাতা গজায়। পুষ্পদণ্ড ৫ থেকে ১৮ সেন্টিমিটার লম্বা। গ্রীষ্মে লম্বা পুষ্পদণ্ডে ফোটে ছোট ছোট, হালকা হলুদ ও সুগন্ধি ফুল। ফল বা শুঁটি শিমের মতো, ১৫ থেকে ২৪ সেন্টিমিটার লম্বা, পাকলে কুঁকড়ে যায় ও দুই কপাটে বিদীর্ণ হয়। ফল পাকলে কুঁকড়ে যায় বলে এর নাম ‘কার্লি বিন’। বীজ ছোট, গাঢ় লাল, মসৃণ ও শক্ত। বীজ ও ডালের কাটিং থেকে নতুন চারা করা যায়। ফুল খুব ছোট হওয়ায় অনেকের চোখেই পড়ে না; কিন্তু শুঁটি ফেটে যাওয়ার পর গাছের নিচে লাল রঙের বীজ ছড়িয়ে থাকে। অনেকেই এই বীজকে ভুল করে রক্তচন্দনের বীজ বলেন। রঞ্জনা ও রক্তচন্দন আলাদা উদ্ভিদ। রঞ্জনার আদি নিবাস ভারত, দক্ষিণ–পূর্ব চীন ও মালয়েশিয়া। এই উদ্ভিদ ব্রাজিল, বাংলাদেশ, ভারতসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে পাওয়া যায়।


এই উদ্ভিদের অন্যান্য নাম রঞ্জন, রঞ্জনা, রক্তকম্বল, রঞ্জক, গুঞ্জাদানা ইত্যাদি। এই উদ্ভিদের সংস্কৃত নাম সারাকা, তাম্রাকা, তিলাকা, রতনগুঞ্জা, রঞ্জকা ইত্যাদি। বৈজ্ঞানিক নাম Adenanthera pavonina, এটি ‘Fabaceae’ পরিবারের বৃক্ষ। ‘Adenanthera’-এর অর্থ হচ্ছে পাতাঝরা আর ‘Pavonina’-এর অর্থ হচ্ছে ময়ূর। যৌগিক পক্ষল পাতা দেখতে ময়ূরের পাখার মতো বলে এরূপ নামকরণ করা হয়েছে।

 

রঞ্জনার লাল বীজগুলো দেখতে খুব সুন্দর। সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয় বলে এর নাম ‘রেড লাকি সিড’। অনেকে এই বীজ দিয়ে আংটি, মালা, দুল বানান। বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ এডরেড করনার তাঁর বইয়ে লিখেছেন, প্রাচীন ভারত উপমহাদেশে স্বর্ণকারেরা সোনার ভর পরিমাপে রঞ্জনার বীজ ব্যবহার করতেন। কুঁচের বীজও ব্যবহার করা হতো এ কাজে। রঞ্জনাগাছের কাঠ খুব শক্ত, তাই বাড়ির দরজা–জানালা, আসবাব ও নৌকা তৈরিতে কাজে লাগে। এ গাছের কাঠ থেকে রঞ্জক সংগ্রহ করা হয়।

 

এ গাছের বহুমুখী উপকারিতা রয়েছে। পাতা, বাকল ও বীজ ভেষজ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। অ্যান্টিসেপটিক হিসেবে, বাতের ব্যথা ও প্রদাহ নিরসনে এর ব্যবহার রয়েছে। এ ছাড়া এর বীজ নিউমোনিয়া রোগেও উপকারী। এর বীজ বিষাক্ত, শোধন ছাড়া ওষুধে ব্যবহার করা যায় না। এর কচি পাতা ও গাছের ছালের রস বা ক্বাথ ডায়রিয়া চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। পাতার ক্বাথ গেঁটেবাতে আরাম দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, পাতার নির্যাসে ব্যাকটেরিয়ারোধী ও বীজের নির্যাসে প্রদাহনাশক গুণ রয়েছে।

  • নিউজ ভিউ ৪৭