এবার বরগুনায় প্রসূতি ও নবজাতকের মৃত্যু: ভুল চিকিৎসার অভিযোগ

Shafiul
প্রতিবেদন প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৪ | সময়ঃ ০৪:০৬
photo

অপরাধ সূত্র :

খতনা করাতে গিয়ে রাজধানীর ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকের অবহেলায় শিশু আয়ানের মৃত্যুর পর এবার বরগুনা জেলার বামনা উপজেলায় একটি অবৈধ বেসরকারি হাসপাতালে এক প্রসূতি ও তার নবজাতক সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। ভুল চিকিৎসায় তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনরা।

 

তারা জানান, সোমবার রাত পৌনে ১১টার দিকে বামনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশে সুন্দরবন হসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভর্তি করা হয় প্রসূতি মেঘলা আক্তারকে। অনুমোদনহীন এই হাসপাতালে তাকে সিজার অপারেশন করেন এক হাতুড়ে ডাক্তার। ভুল চিকিৎসায় মা ও নবজাতকের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় গতকাল ঐ হাসপাতালটি সিলগালা করে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।

 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সারাদেশে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে ও আশপাশে হাজার হাজার অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে তারা অবৈধভাবে ব্যবসা করলেও স্বাস্থ্য বিভাগ ঠিকমতো মনিটরিং করছে না। উল্টো তাদের কাছ থেকে  নিয়মিত মাসোহারা পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এগুলো দেখভাল করার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে অধিদপ্তর, বিভাগীয় পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়, সিভিল সার্জন কার্যালয়, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তারা রয়েছেন। পাশাপাশি রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে মনিটরিং কমিটি। কিন্তু এসব কমিটি ঠিকমতো কাজ করছে না। মনিটরিংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ৯০ ভাগ কর্মকর্তা নিয়মিত নির্ধারিত হারে মাসোহারা পেয়ে থাকেন। এ কারণে আয়ান ও মেঘলা আক্তারের মতো কত মানুষ যে অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে তার  কোন হিসাব নেই।

 

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, দায়িত্বে অবহেলা, ভুল চিকিৎসায় যারা জড়িত এবং এসব মনিটরিং যারা করছেন না তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে, জেল-জরিমানা করে কিছুই হবে না। এদের কারণে শিশু আয়ান ও প্রসূতি মেঘলার মতো প্রতিদিনই অনেকের জীবন যাচ্ছে, এটা হত্যার শামিল। তাই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা (ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট) নিতে হবে। তাহলেই অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক করে মানুষ মারার বাণিজ্য কমে আসবে বলে তারা জানান। 

 

এদিকে অবৈধ ও অননুমোদিত সব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে স্বাস্থ্যখাতে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যখাতে অনেক সমস্যা রয়েছে। আমি বলেছি দুর্নীতির ব্যাপারে ছাড় দেব না। এই অননুমোদিত, লাইসেন্স ছাড়া হাসপাতাল , ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার-এগুলো চলতে দেওয়া যাবে না। বিষয়টি আমি এক দিনে পারব না। কিন্তু আমার মেসেজ হচ্ছে যে এই অননুমোদিত ক্লিনিক, হাসপাতাল বন্ধ করে দিতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবশ্যই নেওয়া হবে। আমি নিজেও ভুক্তভোগী এগুলোর জন্য।’

 

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অপারেশন থিয়েটার, প্যাথলজি সেন্টার এবং ডাক্তার-নার্সের পদ রয়েছে। তবে বাস্তব চিত্র হলো অনেক জায়গায় টেকনিশিয়ান নেই, ডাক্তার আছে। আবার অনেক জায়গায় অজ্ঞানকারী চিকিৎসক আছে, কিন্তু সার্জন নেই। বেশিরভাগ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এই অবস্থা। জনবল সংকটের কারণে অনেক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স তালাবদ্ধ আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক শ্রেণির কর্মকর্তা এসব দেখেও কোন ব্যবস্থা নেন না। তারা লাইনবাজ, দলবাজ ও ঘুষখোর হিসেবে পরিচিত। তবে নিয়মিত ঘুষের প্যাকেট ঠিকই পান বলে অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান।

 

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, সরকারি স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বাড়ানো জরুরি। কারণ দেশে দৈনিক ইমার্জেন্সি দেড় লাখ বেড প্রয়োজন হয়। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট বেড আছে অর্ধলক্ষাধিক। বাকি রোগীরা যাবে কোথায়? এই সুযোগে  ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠেছে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এর মধ্যে বৈধ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা ১৫ হাজার। এর চার গুণ বেশি রয়েছে অবৈধ। এসব অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক চিকিৎসক-নার্স-টেকনোলজিস্ট তো দূরের কথা, ভুয়া ডিগ্রির লোকজন দিয়ে অবাধে চলছে প্রশাসনের নাকের ডগায়। আর অসাধু কর্মকর্তাদের কারণে দেশে অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের লাগাম টানা যাচ্ছে না। একটি হাসপাতাল-ক্লিনিক করার জন্য যেসব যন্ত্রপাতি ও জনবল থাকতে হয়, তার বিন্দুমাত্র নেই এসব অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিকে। বেসরকারি ৯০ ভাগ হাসপাতাল-ক্লিনিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ন্যূনতম গাইডলাইন অনুসরণ করা হয় না।

 

বামনা (বরগুনা) সংবাদদাতা জানান, মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে বামনা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তারেক হাসান, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান এবং বামনা থানা অফিসার ইনচার্জ তুষার কুমার মন্ডল ভুল চিকিত্সায় মা-নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় সুন্দরবন হসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে তালা লাগিয়ে দেন এবং ভর্তিকৃত রোগীদের বামনা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসেন।

  • নিউজ ভিউ ৪৫