অপরাধ সূত্র :
ছয় বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে বাংলাদেশকে জিতিয়েছেন ৪টি সোনাসহ ১৩টি পদক। চার সোনার তিনটিই এসেছে ২০২২ সালে এশীয় পর্যায়ে একই টুর্নামেন্ট থেকে। এই কৃতিত্ব বাংলাদেশের আর্চারদের মধ্যে শুধু তাঁরই। সেটিরই স্বীকৃতি হিসেবে গত বছর ২৮ মে পেয়েছেন বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের ২০২২ সালের বর্ষসেরা আর্চারের পুরস্কার।
সেই আর্চারি তারকা নাসরিন আক্তার আর্থিক দিকটাকে প্রাধান্য দিয়ে আপাতত বেছে নিয়েছেন অন্য জীবন। গত বছর ১৩ জুন এক বছরের জন্য গেছেন জাতিসংঘ মিশনে। সেনাবাহিনীর ল্যান্স করপোরাল নাসরিনের জীবন এখন আর্চারি থেকে দূরে, অন্য ছকে বাঁধা। যেখানে তিনি একজন শান্তিরক্ষী। এই জীবনে নেই রোজ তির–ধনুকে নিশানা ভেদের খেলা। আছে শুধু বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ১৫ গুণ বড় যুদ্ধবিধ্বস্ত মধ্য আফ্রিকার দেশ কঙ্গোতে একাগ্রে পেশাগত দায়িত্বপালন।কঙ্গোর বুনিয়াতে তাঁর সঙ্গে জাতিসংঘ মিশনে একই ইউনিটে আছেন শুটার মোহাম্মদ ইউসুফও। জাতীয় দলের সাবেক আর্চার তামান্না পারভীন, কুস্তি খেলোয়াড় শারমিন আক্তার বুনিয়াতে আছেন অন্য ইউনিটে। আরেক শহরে আছেন এশিয়ান গেমসে পঞ্চম হওয়া বক্সার সেলিম হোসেন। প্যারিস অলিম্পিকের জন্য অন্য আরও পাঁচ খেলোয়াড়ের সঙ্গে সেলিমের জন্যও ওয়াইল্ড কার্ড চেয়েছে বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন। সেটি পেলে সেলিম আগেই ফিরে আসবেন মিশন থেকে।
কিন্তু নাসরিন এক বছর শেষ করেই ফিরবেন। সেই এক বছর শেষ হতে প্রায় পাঁচ মাস বাকি। কঙ্গোতে এখন কেমন কাটছে পটুয়াখালী সদরের মেয়ের জীবন? প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠে পিটিতে অংশ নেওয়া, সকাল আটটার দিকে আধা ঘণ্টা দূরত্বের অফিসে যাওয়া, বেলা দুইটায় বিরতি শেষে অফিস থেকে বাসস্থানে আসা, মধ্যাহ্নভোজ শেষে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার অফিসে যাওয়া—সবই চলে ঘড়ি ধরে।বিকেলে এক ঘণ্টা গেমস হয়। ভলিবল, ব্যাডমিন্টন খেলেন। সন্ধ্যার মধ্যেই সেরে ফেলেন রাতের খাবার, রোলকল হয় তখন। কখনো কখনো রাতেও ডিউটি থাকে। তবে আসল কাজটার জন্য তৈরি থাকতে হয় সব সময়। সেটি কেমন? ৪ হাজার ৩০০ কিমি দূর থেকে টেলিফোনে নাসরিন জানান, ‘যুদ্ধের প্রস্তুতি সব সময় নিয়ে রাখতে হয় আমাদের। যদি যুদ্ধ লেগে যায়, তাহলে নিজের আত্মরক্ষার সঙ্গে সঙ্গীদের রক্ষার জন্যও ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। কোথাও গেলে অস্ত্র, গুলি সঙ্গে নিই। কখনো যুদ্ধ লেগে গেলে পরিস্থিতি যেন সামাল দিতে পারি।’
স্থানীয় লোকজন আসেন। কেউ আসেন চিকিৎসা নিতে, কেউবা খাবারের সন্ধানে। স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য ভাষা কোর্স হয়, আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি শেখানো হয়। পড়াশোনার ব্যবস্থা দেশটিতে কম। নাসরিন বলেন, ‘অফিসে যাওয়ার সময় অনেক স্থানীয় বাসিন্দা আমাদের বন্ধু বলে ডাকে। ওরা বোঝে, অন্য দেশ থেকে এসেছি, থাম্বসআপ দেখায়। আবার অনেকে হয়তো মনে করে, আমরা তাদের ভালো করতে আসিনি। তারা বোঝায়, তোমাদের মেরে দেব, গুলি করে দেব...।’
এটা একটু ভয়েরই। কারণ, কিছু খারাপ লোক বা গোষ্ঠী আছে সেখানে। ওরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে। মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে, গলা কেটে ফেলে, ধর্ষণ করে। ওই সব লোকদের কীভাবে সামাল দেন নাসরিন, জানালেন সেটাও, ‘আমরা তাদের বোঝাই যে তাদের খারাপ অবস্থা থেকে বাঁচাতে এসেছি এখানে। গরিবদের নানা কাজের মাধ্যমে সহায়তা করি। বিভিন্ন টহলে গিয়ে দেখি, সব ঠিক আছে কি না। দেখা গেছে, বিদ্রোহীরা গ্রামে ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। আমরা তাদের সহায়তা করি, সেখানে যাই।’
যাওয়া–আসার পথে সবচেয়ে বেশি কী চোখে পড়ে? স্থানীয় মোটরসাইকেল বা বাইক। নাসরিন বলেন বিস্তারিত, ‘এখানে চমকপ্রদ একটা দৃশ্য দেখি সব সময়। একটা বাইকে পাঁচ-ছয়জন মানুষও ওঠে। দেখা যায়, বাইকে ছাগল আর মানুষ একসঙ্গে যায়। বাইকে গরুও তোলে ওরা, এমনকি ফ্রিজও। বড় বড় বস্তা নেয়। সেটার সঙ্গে অবশ্যই দুজন লোক থাকবেই। বাইকেই সবকিছু আনা–নেওয়া করে। যেটা আমাদের দেশে হয় না।’তবে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে যেমন জাতীয় প্যারেড হয়, কঙ্গোতেও তা হয়। এটাকে আন্তর্জাতিক মেডেল প্যারেড বলে। শান্তি রক্ষা বাহিনীতে যাওয়া ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, মরক্কোসহ নানা দেশের সৈনিকেরা প্যারেড করেন। নাসরিনের কাছে যা দারুণ লাগে। বিভিন্ন দেশের সেনাদের সঙ্গে কথা বলা যায়। নানা অভিজ্ঞতা বিনিময় হয়।এসবের মধ্যে থেকেও কোথাও যেন নাসরিনের মনে শূন্যতার হাহাকার বাজে। মন উতলা হয়ে ওঠে দেশে ফেরার জন্য। নাসরিন বলেন, ‘সব সময় ভাবি, কবে দেশে ফিরব। আবার কবে আর্চারি শুরু করব।’ নিজের তির–ধনুকটা খুব মিস করেন, সেটা মনে করে একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে থাকেন, ‘আমার তির, ধনুক—সবই অন্যের হয়ে গেছে এখন। খুবই খারাপ লাগে। ধনুকটা যেন আমার বাচ্চার মতো। ওটা দিয়ে এত সাফল্য পেলাম। জমা দিতে না হলে সারা জীবন নিজের কাছে রাখতাম। কিন্তু জমা দিতে হয়েছে। আমি ধনুকটা বিছানার পাশে রেখে ঘুমাতাম। ঘুম ভেঙে দেখতাম ঠিক আছে কি না। আর এখন সেই ধনুকটাই আমার কাছে নেই। খারাপই লাগে।’মিশনে বিদেশিরা নাসরিনকে ‘আর্চারি গার্ল’ বলে ডাকেন। আর অনেকে বলেন, ‘তুমি তোমার ধনুক নিয়ে আসোনি কেন।’ কিন্তু ওইভাবে তো আনা যায় না। ধনুক নিয়ে গেলেও শুধু সেটা দিয়ে প্র্যাকটিস হবে না। মন খারাপ কাটাতে অবসর সময়ে বাগান করেন নাসরিন। লাউ, পুঁইশাক, কুমড়া, মুলা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, কলমি শাক, পালংশাকের চাষাবাদ করেছেন। স্থানীয় লোকজন শাকসবজি বেশি চেনে না, খায়ও না। তবে অবস্থাটা একটু বদলাতে শুরু করেছে এখন, ‘আমরা বাগান করার পর তাদের দিই। কেউ কেউ আমাদের থেকে বীজ নিয়ে চাষাবাদ শুরু করেছেন। এখানে ১২ মাসই ফল থাকে। যখন আসি, কাঁঠাল দেখেছি। অ্যাভোকাডো ফলটা বেশি এখানে।’ কোনো কিছুই শান্তিরক্ষী নাসরিনকে টানে না। তাঁর মন যে পড়ে আছে ভালোবাসার আর্চারিতেই।