অপরাধ সূত্র :
নির্বাচনে ভরাডুবির পর জাতীয় পার্টির (জাপা) বিরোধী দলের আসনে বসাটাও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। এ নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। এর মধ্যেই নির্বাচন ঘিরে দলটির ভেতর অস্থিরতা বাড়ছে। নির্বাচনে শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ এনে নেতা-কর্মীদের একটি অংশ দলের বনানীর কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করেছে।
জাপার সূত্রে জানা গেছে, বিক্ষোভের রেশ এখনো কাটেনি। আজ রোববার রাজধানীর কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বিক্ষুব্ধ নেতারা সভা ডেকেছেন। নির্বাচনে জাপার মনোনয়নে প্রার্থী হয়ে পরাজিত হয়েছেন অথবা নির্বাচন বর্জন বা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছিলেন—এমন নেতাদের অনেকে সভায় উপস্থিত থাকবেন বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।সভার অন্যতম আয়োজক জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টির আড়াই শ প্রার্থীর মধ্যে হাহাকার। কেন চেয়ারম্যান-মহাসচিব তাঁদের খোঁজখবর নিলেন না, ফোন ধরলেন না—এ নিয়ে প্রার্থীদের মধ্যে অনেক ক্ষোভ-আক্ষেপ আছে। সভায় তাঁরা সেটি তুলে ধরবেন। এরপর আমরা চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলব।’
এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে শুরু থেকে নাটকীয় অবস্থান ছিল জাপার শীর্ষ নেতৃত্বের। অনেকটা রাখঢাক করে সরকারি দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ২৬টি আসনে সমঝোতায় নির্বাচনে অংশ নেয় দলটি। এ নিয়ে বঞ্চিত নেতাদের অনেকের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে ঢাকা ও আশপাশের চার-পাঁচজন নেতা যাঁরা ঢাকার কর্মসূচিগুলোতে জমায়েতের ক্ষেত্রে ভালো অবদান রাখেন, তাঁরা সমঝোতার আসনে না থাকায় অসন্তোষ বাড়ে। যদিও সমঝোতার ২৬ আসনের মাত্র ১১টিতে জয় পায় জাপা। এবার ভোটে দলটির প্রার্থীদের ৯০ শতাংশই জামানত হারিয়েছেন। নির্বাচনের ভরাডুবির পর সে ক্ষোভ আরও বেড়েছে। তাতে দলের জ্যেষ্ঠ কিছু নেতার ইন্ধন রয়েছে বলে শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছেন।
গতকাল শনিবার দুপুরে বনানীর কার্যালয়ে এক সভায় জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য শেরীফা কাদের দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, যাঁরা নির্বাচনই করেননি, তাঁরাও নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন। জাপাকে পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করতেই তাঁরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন। জাপার বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র সফল হবে না।
আসন সমঝোতার বাইরে ঢাকা-৪ আসন থেকে প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন জাপার গত দুবারের সংসদ সদস্য ও কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন। তিনি গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রার্থীদের অনেক কষ্ট আছে। নির্বাচনের সময় শীর্ষ নেতারা ফোন ধরেননি, পয়সাকড়ি পাননি। আমার মনেও ক্ষোভ আছে। জাতীয় পার্টির জন্ম দিয়েছি, ৪৩ বছর এই দলের রাজনীতি করছি। কেন এমন হলো, এ বিষয়গুলো আলোচনা করব।’
৭ জানুয়ারির ভোটের পর গত বৃহস্পতিবার সকালে জাপার বনানীর কার্যালয়ের সামনে নেতা-কর্মীদের একটি অংশ বিক্ষোভ করে। এতে ঢাকা ও আশপাশের এলাকার কয়েকজন প্রার্থীও ছিলেন। তাঁরা নির্বাচনে আর্থিক সহযোগিতা না করা, ভোটের সময় প্রার্থীদের ফোন না ধরাসহ বিভিন্ন অভিযোগে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হকের (চুন্নু) পদত্যাগ দাবি করেন। এর জেরে গত শুক্রবার কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ ও প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়কে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। জাপা থেকে অব্যাহতির বিষয়ে কাজী ফিরোজ রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা আমার জীবনে খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এ ছাড়া রাজনীতি আমার পেশা নয়। তাই অব্যাহতি নিয়ে ভাবছি না।’ওই বিক্ষোভের পর আজ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে বিক্ষুব্ধ নেতারা সভা ডেকেছেন। জাপার দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, এ সভায় কারা আসেন, কী বক্তব্য দেন, সেটি দেখতে চাইছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। এরপর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এর আগে মঙ্গলবার রাতে ধানমন্ডিতে জাপার কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ বেশ কয়েকজন পরাজিত প্রার্থী বৈঠক করেছিলেন। সেখানে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করে ভোটের সময় অসহযোগিতার জন্য জবাবদিহি করতে বিক্ষোভের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ ঘটনায় দুই নেতাকে অব্যাহতি দেওয়ার পর তাঁদের অনেকে অবস্থান পাল্টে জি এম কাদেরের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে আবার ফিরেছেন বলে জানা গেছে। তবে দল থেকে অব্যাহতি পাওয়া সুনীল শুভ রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি, নির্বাচনে জাতীয় পার্টির এই বিপর্যয়ের জন্য পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর অদূরদর্শিতা ও ব্যর্থতা দায়ী।’
এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাপা ২৮৩ আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বাছাইয়ে ২৬৫ জনের প্রার্থিতা টেকে। এর মধ্যে নির্বাচনের প্রচার শুরুর পর থেকে ৭ জানুয়ারি ভোটের আগপর্যন্ত ১৯ জন প্রার্থী দলের শীর্ষ নেতৃত্বের অসহযোগিতা, নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে সংশয়, ভোটের মাঠে হুমকি ও চাপের কথা জানিয়ে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। এর বাইরে জাপার আরও ১১ জন প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন পেয়েও প্রত্যাহার করেন। সব মিলে দলটির ৩০ জন প্রার্থী নির্বাচন বর্জন ও প্রত্যাহার করেন।