অপরাধ সূত্র :
৭ জানুয়ারি দেশব্যাপী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এ নির্বাচনে যথাবিহিত ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছে। আওয়ামী লীগ আবারও রাষ্ট্র ক্ষমতায় যে আসবে, তা আগে থেকেই ধারণা করা গিয়েছিল। নির্বাচনটি ছিল শুধু আনুষ্ঠানিকতা মাত্র অথবা এ নির্বাচনকে সংবিধানের নিয়মরক্ষার নির্বাচনও বলা চলে। এজন্য অবশ্য জনগণের কষ্টার্জিত আনুমানিক তিন হাজার কোটি ব্যয় করতে হয়েছে। সংবিধান রক্ষায় জনগণের এ পরিমাণ অর্থ খরচ করা, খুব বেশি ক্ষতিকর হয়েছে বলা ঠিক হবে না। যেখানে এ দেশেরই কিছু ব্যক্তি হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে পার পেয়ে গেছেন, সেখানে জাতীয় নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট আয়োজনে তিন হাজার কোটি টাকা খরচ করা খুব বেশি কিছু নয়। এ বিষয়ে আমাদের আলোচনা করা উচিত হবে না। উপরের উক্তিটি আমার নয়। উক্তিটি আমার স্কুলপড়ুয়া এক বন্ধুর; যিনি আজীবন আওয়ামী রাজনীতি করেছেন। এখন এ মধ্য বয়সে এসে দলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে কিছুটা বিরক্ত। তিনি কথা প্রসঙ্গে ৭ তারিখে অনুষ্ঠিত অতীতের আরেকটি নির্বাচনের কথা টেনে এনে বলেন, ‘পাকিস্তানি প্রশাসনের অধীন ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ে সেদিন সব বাঙালি যে গৌরব অনুভব করেছিল, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে এত বড় বিজয়ের পরও কেন আমরা বিন্দুমাত্র গৌরব অনুভব করতে পারছি না?’ আমার বন্ধুর এ প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলেও কোনো জবাব দেইনি। কারণ আমি জানি, এ প্রশ্নের উত্তরও ওর জানা আছে। মনে মনে শুধু ওর ভেতরকার কষ্টটুকু অনুভব করার চেষ্টা করেছি।
এবারের নির্বাচন নিয়ে আমার বন্ধুর মতো আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীরই এমন প্রশ্ন থাকতে পারে। বর্তমান আওয়ামী লীগকে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের সঙ্গে অনেকেই হয়তো তুলনা করতে পারেন। আওয়ামী লীগের মৌলিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী কিছু ব্যক্তির মনে এ নির্বাচন নিয়ে অনেক কষ্ট থাকতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, এমন নির্বাচন আয়োজন ছাড়া আওয়ামী লীগের সামনে আর কী বিকল্প ছিল? বিরোধী দল ও পশ্চিমা বিশ্বের কথা মেনে নিয়ে যদি নির্বাচন করা হতো, তাহলে নির্বাচনের পর যে পরিস্থিতি হতে পারত, তার জন্য কি দল প্রস্তুত ছিল? এখানে বুঝতে হবে, দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা অনেক চিন্তা-ভাবনা করেই এমন নির্বাচনের আয়োজন করেছেন। কারণ, তারা ভালো করেই জানেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর কিছু হয়নি। ২০১৮ সালের পরও নয়। কাজেই ভয়ভীতি যাই-ই থাকুক, এবারেও কিছু হবে না ইনশাআল্লাহ।
এবারের নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলেও গণতন্ত্র হেরে গেছে। যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করতে গিয়েই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এদেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই গণতন্ত্র আওয়ামী লীগের হাতেই এমনভাবে কাটাছেঁড়া হবে তা চিন্তা করা যায় না। আওয়ামী লীগ নেতানেত্রীরা গণতন্ত্রকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করতে চাচ্ছেন, তার সঙ্গে প্রকৃত গণতন্ত্রের কতটুকু মিল আছে তা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। নির্বাচন-উত্তর এক সংবাদ সম্মেলনে বিরোধী কোনো দল না থাকলে বাংলাদেশকে একটি সক্রিয় গণতান্ত্রিক দেশ বলা যায় কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে আওয়ামী লীগ নেত্রী বলেছেন, ‘বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি বলে দেশে গণতন্ত্র নেই, সেকথা ঠিক নয়। বরং জনগণ যে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে সেটিই বড় বিষয়।’ গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী দল থাকাটা জরুরি, তা উল্লেখ করে আরেক সাংবাদিক মন্তব্য জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ নেত্রী বলেন, ‘আমি বিরোধী দলে ছিলাম দীর্ঘদিন ধরে। আমাদের দলকে আমরা সংগঠিত করেছি। বিরোধী দলকে তাদের নিজেদের সংগঠিত করতে হবে। আপনি আমাকে বিরোধী দল গঠন করতে বলতে পারেন না। অবশ্য আপনি চাইলে আমরা সেটা করতে পারি। কিন্তু সেটা আসল বিরোধী দল হবে না।’ এ লেখাটি যখন লিখছি, তখন পর্যন্ত সংসদে বিরোধী দল কারা হবে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছিল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি।
এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২২২ আসনে জয়লাভ করেছে। স্বতন্ত্র পেয়েছে ৬২, জাতীয় পার্টি ১১ এবং ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও কল্যাণ পার্টি ১টি করে আসনে বিজয়ী হয়েছে। এ অবস্থায় জাতীয় পার্টির সদস্যরা নিশ্চিত নন যে, তারা বিরোধী দলের আসনে বসবেন কিনা। জাতীয় পার্টির তুলনায় এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীরা প্রায় তিনগুণ বেশি আসন পেয়েছেন। অতঃপর স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা নিজেদের মধ্যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচন করার সুযোগ থাকায় তাদেরও সম্ভাবনা আছে। ফরিদপুর থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্য আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন, স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যরা আলোচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্যদের মধ্যে দু-একজন বাদে সবাই আওয়ামী লীগের সদস্য। অতএব, দলের নেত্রীর সম্মতি পাওয়ার পরই তারা বিরোধীদের আসনে বসতে পারবেন। তবে, অধিকাংশ আওয়ামী লীগের বিজয়ী স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্য সরকারদলীয় আসনেই বসার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে জানা গেছে। তবে আওয়ামী লীগের ওবায়দুল কাদের এ বিষয়ে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, বিরোধী দল ঠিক করবেন সংসদ নেতা ও স্পিকার। আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকেও নাকি সংসদের বিরোধী দল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। জানা গেছে, ওই বৈঠকে সংসদ নেত্রী বলেছেন, তিনি বিরোধী দল নিয়ে স্বতন্ত্র ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে কথা বলবেন। এ যখন পরিস্থিতি, তখন মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, এটি কোন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যেখানে সংসদে বিরোধী দল কারা হবেন সরকারদলীয় সংসদ নেত্রীকেই তা ঠিক করে দিতে হয়?
নির্বাচন নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। এবারের নির্বাচন যে অভিনব কায়দায় অনুষ্ঠিত হলো, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তা ক্ষতচিহ্ন হয়ে থাকবে। প্রশাসনের সহায়তায় এ নির্বাচনটি ছিল অনিয়ম-কারচুপির নির্বাচন। ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, বিরোধীদের এজেন্ট বের করে দেওয়া, কেন্দ্র দখল, বাধা দেওয়া এবং জাল ভোট প্রদান সবই ছিল এ নির্বাচনে। এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের অভিযোগ করে বলেছেন, ‘সরকারের নিয়ন্ত্রণে এ নির্বাচন হয়েছে। সরকার যেখানে নিরপেক্ষ করতে চেয়েছে, সেখানে নিরপেক্ষ হয়েছে। সরকার যেখানে যাকে জেতাতে চেয়েছে, সেটিই করেছে।’ আন্তর্জাতিকভাবে এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে কিনা তা নিয়েও তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন। আওয়ামী লীগের শরিক দল জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনুও ভোট জালিয়াতির কথা বলেছেন। জনগণের ভোটে নয়, কারচুপির ভোটে তাকে পরাজিত করা হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। নির্বাচনের কারচুপি নিয়ে নৌকার অনেক প্রার্থীরও বিস্তর অভিযোগ আছে। তবে এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী বলেছেন, ‘কে কী বলছে তা নিয়ে মাথা ঘামাই না। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছি আমরা।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘এ নির্বাচন দেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।’ নির্বাচনের পর পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় চীন, রাশিয়া ও ভারতসহ অনেক বিদেশি সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তবে, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য আওয়ামী লীগ অনেক পরিকল্পনাই করেছিল। এর মধ্যে অন্যতম হলো, তারা চেয়েছিল, ৫০ শতাংশও ভোটও যদি কাস্ট করানো যায়, তাহলে নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হয়েছে বলে প্রচার করা যাবে। এজন্য তারা ব্যাপক প্রস্তুতিও নিয়েছিল। এমনকি ভোট কেন্দ্রে না গেলে সরকারি সুযোগ-সুবিধা কেটে দেওয়া হবে বলে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা হুমকিও দিয়েছিলেন। তাতে কোনো ফল হয়নি। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে ও সংবাদমাধ্যমের হিসাব অনুযায়ী, সেদিন ২০ শতাংশের নিচে ভোট কাস্ট হলেও নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে ৪১.৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। ভোট শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার সাংবাদিকদের ব্রিফ করতে গিয়ে প্রথমে ২৮ শতাংশ ভোট কাস্ট হওয়ার কথা বলেছিলেন। পরে তিনি অবশ্য সংশোধন করে ৪০ শতাংশের কথা বলেন। তিনি দুপুর ২টা পর্যন্ত ২৮ শতাংশ ভোট কাস্টের কথা উল্লেখ করেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কথা অনুযায়ী, সারা দিন পর দুপুর ২টা পর্যন্ত যেখানে ভোট পড়েছে ২৮ শতাংশ, বাকি ২ ঘণ্টায় কী করে এত বেশি, প্রায় ১৪ শতাংশ ভোট পড়ে? একতরফা এ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির যে চেহারা বেরিয়ে এসেছে তা সত্যিই আশঙ্কাজনক। নির্বাচনে, পক্ষে এবং বিপক্ষে কে বা কারা প্রার্থী হবেন এবং নির্বাচন-উত্তর সংসদের বিরোধী দল কারা হবে সেটি ঠিক করতেও যদি সরকারদলীয় নেতার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করতে হয়, তখন দেশের ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই মনে করেন, এ নির্বাচন নাগরিকদের ভেতর দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থার ভীতি বাড়িয়ে তুলেছে। সরকারপ্রধানই যদি সংসদের বিরোধী দল ঠিক করে দেন, তাহলে সেই দল, যে কোনো ইস্যুতেই সংসদের ভেতরে ও বাইরে ক্ষমতাসীন দলকেই সমর্থন করে যাবে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একদলীয় শাসনের পথে অগ্রসর হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন আছে।
আগেই উল্লেখ করেছি, নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো প্রশ্ন তুলেছে। নবগঠিত সরকারকে তারা এখন পর্যন্ত অভিনন্দন জানায়নি। এসব রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কী হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র এ নির্বাচনের বিষয়ে তাদের আগের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটেনি বলে জানিয়ে দিয়েছে। জাতিসংঘও নির্বাচন নিয়ে সন্তুষ্ট প্রকাশ করেনি। এ ছাড়াও বিশ্বের বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংগঠন, সব দলের অংশগ্রহণে আবারও নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় দেশগুলো বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনের ক্ষেত্রে যদি বিশেষ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটবে। আগামী তিন মাস নতুন সরকারকে অনেকটা কঠিন সময় পার করতে হবে। যদি এমন কিছু হয়, আগামী তিন মাস সময়ের মধ্যেই তার লক্ষণ দেখা যাবে। এ সময় সরকারকে আন্তর্জাতিক সব মহলের সঙ্গেই ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে যেতে হবে। নতুন সরকার ইতোমধ্যে সঠিকভাবেই তাদের জন্য তিনটি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো-রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক। তাদের এ তিনটি চ্যালেঞ্জই, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেই মোকাবিলা করতে হবে। তবে এ সব কিছুই নির্ভর করছে তাদের কূটনৈতিক দক্ষতার ওপর। এজন্য সরকারকে এখন থেকেই কাজ শুরু করে দিতে হবে।
একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা