সুচিত্রা–রূপকথার শেষ হয় না

Shafiul
প্রতিবেদন প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৪ | সময়ঃ ০৫:৫৬
photo

অপরাধ সূত্র :

সেদিন কলকাতায় শীতের বেশ দাপট। রেকর্ড ঠান্ডা। স্পষ্ট মনে পড়ছে, অন্য দিনগুলোয় শীতে কাবু মানুষ রাস্তায় কম বের হতেন। কিন্তু কলকাতার গোর্কি সদনের পাশের রাস্তায়, মিন্টো পার্কের সামনে, বেসরকারি হাসপাতাল বেলভিউয়ের সামনের চিত্রটা ছিল ভিন্ন। সেখানে জনসমুদ্র। কলকাতায় সেদিন একটা গান সারা দিনই শোনা গেছে, ‘আরও কিছুটা সময় না রহিতে…’।
২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারির কথা বলছি। সেদিন সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে পৃথিবীর বাতাসে শেষবারের মতো নিশ্বাস নেন সুচিত্রা সেন, পাড়ি দেন অনন্তলোকে। তবে বলতেই হয়, সেদিন কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন উত্তম কুমারের সুচিত্রা; ‘হারানো সুর’-এর রমা, ‘সপ্তপদী’র রিনা ব্রাউন, ‘সাত পাকে বাঁধা’র অর্চনা, ‘উত্তর ফাল্গুনী’র দেবযানী, পান্না বাঈ বা সুপর্ণা। আমাদের পাবনার মেয়ে সুচিত্রা। আজ তাঁর দশম প্রয়াণদিবস।


‘ফিরে এসেছিলেন’ বলার কারণ, তিনি থেকেও ছিলেন না। তিনি ছিলেন, তবে কলকাতা তাঁকে দেখেনি। তাঁকে দেখা যায়নি নন্দনে, নিউমার্কেটে, ধর্মতলায়, সল্টলেক বা পার্ক সার্কাসে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর তাঁকে দেখেননি কেউ।


তাই বলে কি সুচিত্রাকে জানেন না সেকাল কিংবা একালের বাঙালি? সুচিত্রাকে না জানাটাই বরং অসম্ভব। সুচিত্রা তো প্রজন্মের পর প্রজন্মের ক্র্যাশ। এ যুগে মাধুরীরা গর্ব করে বলেন, তাঁকে দেখতে সুচিত্রার মতো। এখনো শোনা যায়, শিশুরা খেলছে সুরে সুরে—‘আকাশ থেকে নেমে এল ছোট্ট একটা প্লেন/ সেই প্লেনে বসে ছিল লাল–টুকটুক মেম/ মেমকে আমি জিজ্ঞেস করলাম,/ ‘হোয়াট ইজ ইয়োর নেম?’/ মেম বলল, ‘মাই নেম ইজ সুচিত্রা সেন!’ দুই বাংলায় এতটা চর্চা আর কাকে নিয়ে হয়েছে?

এ কথা তো সবাই জানেন, সুচিত্রা তাঁর সম্মোহনী সৌন্দর্যের আগল ভাঙেননি জীবনকালে। নিজের চারদিকে আচমকা তুলে দিয়েছেন আকাশছোঁয়া, দুর্ভেদ্য এক পাঁচিল। যাতে কোনো অসতর্ক মুহূর্তে তিনি ধরা না পড়ে যান পাপারাজ্জির বাড়াবাড়ি কৌতূহলে।

 

বয়সের সঙ্গে নিজেকে পাল্টে হননি চরিত্রাভিনেত্রী বা পার্শ্ব-অভিনেত্রী। পর্দার অভিনয়জীবনে নিজের যে চূড়ান্ত রোমান্টিক রূপ গড়েছিলেন, স্বেচ্ছা-অন্তরালে সেই রূপই ধরে রেখেছিলেন শেষ জীবনেও। এ নিয়ে কম কথা হয়নি। বরং আজ সুচিত্রাকে নিয়ে কিছু গুজব, কিছু অজানা, কম চর্চা হয়েছে, এমন কিছু বিষয় সামনে আনা যাক বরং। থাকবে তাঁর বলিউডযাত্রার কথাও।

 

আসলেই কি ব্লাড ক্যানসার
শোনা যায়, আশির দশকের শুরুতে নাকি সুচিত্রা সেনের লিউকেমিয়া হয়েছিল। মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে তাঁর বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়। পরবর্তী চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে তাঁর চুল পড়ে যায় এবং ত্বক নষ্ট হয়ে যায়। বুড়িয়ে যাওয়ায় তিনি নাকি লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। এ রকম একটা ধারণা এখনো অনেকের মনে আছে। ২০০৭ সালে কলকাতার সাময়িকী আনন্দলোক–এর সংখ্যায় রক্তরোগবিশেষজ্ঞ আশিস মুখোপাধ্যায় সরাসরি জানান, এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। কেননা, দীর্ঘদিন যাবৎ তিনি মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট ইউনিটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ পর্যন্ত যে কজন রোগীর অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, তাঁদের প্রত্যেকের ইতিহাসই তাঁর জানা। তিনি জানান, রক্তের ক্যানসার না হলেও সেপ্টিসিমিয়া–জাতীয় গুরুতর কোনো সংক্রমণ হয়েছিল সুচিত্রার। সুচিত্রা সেনকে যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়া হয়। সেখানে শরীরের দূষিত ও সংক্রামিত রক্ত বদলে পরিশুদ্ধ রক্ত দেওয়া হয়। রক্ত বদলে ফেলার খবরটা কোনোভাবে ছড়িয়ে পড়ায় অনেকেই মনে করেন, তাঁর রক্তে ক্যানসার বা ক্রনিক মাইলয়েড লিউকেমিয়া (সিএমএল) হয়েছিল। তাঁর রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ সব সময় কম থাকত।

 

মিষ্টি ভালোবাসতেন
মিষ্টি পছন্দ ছিল সুচিত্রার। কলকাতার দেওদর স্ট্রিটে ঢোকার মুখে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে অভিজাত মিষ্টির দোকানের বহু পুরোনো ক্রেতা সুচিত্রা সেন। তাঁর খুব প্রিয় মিষ্টি সেখানকার নরম কাঁচাগোল্লা। তা ছাড়া প্যাড়া, সন্দেশ, স্পঞ্জ রসগোল্লা, গোলাপজামুন, পানি সন্দেশ—ওই দোকানের যা কিছু বিশেষ, তার সবই সুচিত্রার পছন্দের।
সৌভাগ্যক্রমে সুচিত্রার বাড়িতে যাঁরাই অতিথি হয়ে গেছেন, তাঁরাই টের পেয়েছেন, মিষ্টি খাওয়া মানে যেন মিষ্টি উৎসব। এমনও হয়েছে যে মাত্র দুজন অতিথির সামনে তিনি একেবারে হাজির করেছেন ২০-২৫টি হরেক রকম মিষ্টিভর্তি বড় গামলা! সুচিত্রার আপ্যায়নের রীতি প্রায় সবার ক্ষেত্রেই সমান। সতর্কতায় কেউ ‘খাব না’ বললে সুচিত্রার কাছ থেকে এমন আদরমাখা মধুর নির্দেশ আসত যে জীবনে মিষ্টি মুখে না নেওয়া মানুষটিও খেয়ে নিতে বাধ্য হতেন। যেমন বাংলাদেশের অভিনেতা আলমগীর। প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, কত সাধনায় সুচিত্রার দর্শন পেয়েছিলেন তিনি। সেদিন সুচিত্রা নিজেই ট্রেতে কুকিজ, তিনটি নারকেলের নাড়ু, আর এক কাপ চা এনেছিলেন। আলমগীর নারকেল দিয়ে বানানো কোনো খাবার খেতেন না। তাই বিস্কুট আর চা খাচ্ছিলেন। সুচিত্রা সেটা খেয়াল করে বলেন, ‘আলমগীর, তুমি নাড়ু খাচ্ছ না কেন? ওটা আমি নিজ হাতে বানিয়েছি।’ সেবার সুচিত্রা আলমগীরকে অনুরোধ করেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে মরণচাঁদের দই পাঠাতে।

রান্নার বিষয়ে সচেতন ও সাবেকি ছিলেন সুচিত্রা। যেমন রান্নার তেলের ক্ষেত্রে। বিশেষ ব্র্যান্ডের শর্ষের তেল ছাড়া অন্য তেল খেতেন না। এমনিতে সুচিত্রা ছিলেন সহজপাচ্য আহারে অভ্যস্ত। টক দই, শসা আর বিভিন্ন মৌসুমি ফল থাকত তাঁর প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায়।

একদমই যে বাসা থেকে বের হতেন না, তা নয়। সূর্যাস্তের পর তিনি কালো চশমা পরে বের হতেন। অন্ধকারে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে হাঁটা তাঁর অনেক দিনের অভ্যাস। হাতে থাকত ছোট একটি ভ্যানিটি ব্যাগ ও রুমাল।

 

সুচিত্রার দীর্ঘদিনের চিকিৎসক সমরজিৎ নস্কর এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত তাঁকে সোজা হয়ে হাঁটতে দেখেছি। কণ্ঠস্বরও বসে যায়নি। ব্যক্তিত্ব ছিল, তবে তাঁকে কখনো রাশভারী মানুষ মনে হয়নি। সমরজিৎ নস্কর আরও জানিয়েছেন, সুচিত্রা গ্রিলড ফিশ খুব পছন্দ করতে। মসলামুড়ি মাখতেন নিজে, খেতেন প্রায়ই। খবরের কাগজ পড়তেন নিয়মিত। অসহায় মানুষের খবর রাখতেন। ভারতে সুন্দরবন অঞ্চলে দুর্গত মানুষদের সহযোগিতার জন্য ত্রাণ পাঠিয়েছিলেন। নিয়মিত খবর রাখতেন সেখানকার মানুষদের। নিয়মিত মহাশ্বেতা দেবী, নারায়ণ দেবনাথ, সুবীর সেন, মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়...উনি সবার ব্যাপারেই খোঁজ নিতেন।

 

প্রাচ্যের গ্রেটা গার্বো
অনেকেই সুচিত্রাকে ‘প্রাচ্যের গ্রেটা গার্বো’ও বলে থাকেন। খ্যাতির তুঙ্গে থাকতেই ১৯৪১ সালে যিনি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন প্রচারের আলো থেকে। আসলে নিশ্ছিদ্র গোপনীয়তাই দুই নারীকে করে তুলেছে মিথ। গ্রেটা গার্বোর শোবার ঘরে ছিল সাদাসিধে পালঙ্ক, সুচিত্রারও তা–ই। সব সময় ঘর গুছিয়ে রাখতেন তিনি। বিছানা, পর্দা সবই ছিল হালকা রঙের। পছন্দ করতেন রবীন্দ্রসংগীত। সুতির শাড়ি পরতেন, পছন্দ করতেন বুটিওয়ালা, নকশাপাড় ও টাঙ্গাইল। গ্রেটা গার্বোর প্রিয় ছবি ছিল ‘কুইন ক্রিস্টিনা’। যেখানে রানি মনে করেন, তিনিই সব। শেষ অবধি যুদ্ধে মারা যায় রানির প্রেমিক, সেই মৃতদেহ সঙ্গে নিয়ে এক জাহাজে চড়ে রানি ভেসে যান।

সুচিত্রা নাকি বারবারই একটা ছবি করতে চেয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের ‘চতুরঙ্গ’! সেখানে তিনিই সাজবেন দামিনী। সেই দামিনী, যে সারা জীবন শচীশ আর শ্রীবিলাসের টানাপোড়েনে জ্বলতে জ্বলতেও মাথা রেখেছিল স্বামীর পায়ে, বলেছিল, ‘সাধ মিটিল না, জন্মান্তরে আবার যেন তোমাকে পাই!’

 

সুচিত্রা কখনো চাননি তাঁর কন্যা মুনমুন অভিনেত্রী হোক। ১৯৯৮ সালে সাংবাদিক ধীরেন দেব এক সাক্ষাৎকারে এমনটাই বলেন। সুচিত্রা চেয়েছিলেন মেয়ে অনেক লেখাপড়া করবে। ধীরেন দেব আরও জানান, খুব ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসতেন সুচিত্রা। সময় পেলেই বেরিয়ে পড়তেন। কিছু পছন্দ না হলে মুখ বাঁকিয়ে একটা শব্দ বলতেন, কচু!

 

বলিউডের পার্বতী
সুচিত্রা সেনের বলিউডি ক্যারিয়ার খুব বড় নয়। তাঁর মামাশ্বশুর পরিচালক বিমল রায়ের দেবদাস ছবিতে মধুবালা-মীনাকুমারীকে না পেয়ে যখন হন্যে হয়ে ‘পার্বতী’র চরিত্রের জন্য সরল, বাঙালি মুখশ্রী খুঁজছেন বিমল, তখন তাঁর মাথায় হঠাৎই আসে সুচিত্রার কথা। দিলীপ কুমারের মতো সুপারস্টারের বিপরীতে প্রায় নবাগতা সুচিত্রাকে কাস্ট করে তিনি ঝুঁকিই নিয়েছিলেন বলা যেতে পারে। এরপর ১৯৬০ পর্যন্ত মুসাফির, চম্পাকলি, বোম্বাই কা বাবু ও সরহদ—চারটি হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা।
সুচিত্রার বিপরীতে কাজ করেছেন দেব আনন্দ, ভারতভূষণের মতো নায়কেরা। হিন্দি উচ্চারণে আড়ষ্টতা এবং হিন্দি ছবির অন্য নায়িকাদের মতো নাচে পারদর্শী না হওয়াটা তাঁকে বেশ ভুগিয়েছিল।


অভিনয়ের দিক থেকে দেখতে গেলে ১৯৭৪ সালে সুচিত্রা অভিনীত আঁধি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ‘আরতি দেবী’ হিসেবে সুচিত্রা অনেক জায়গায় ইন্দিরা গান্ধীকে অনুকরণ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তা বোধ হয় পরিচালকেরই নির্দেশে।


বলিউড তারকা মাধুরী দীক্ষিত সুচিত্রার ভক্ত। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, অনেকেই তাঁকে ‘সুচিত্রার মতো দেখতে’ কথাটা বলেন। দয়াবান সিনেমার শুটিংয়ে অভিনেতা পরিচালক ফিরোজ খান ক্যামেরায় লুক থ্রু করে একই কথা বলেছিলেন। মাধুরী ভাষ্য, ‘শুনেছি, আঁধির পর সুচিত্রা সেন আর কোনো হিন্দি ছবিতে কাজ করেননি। কজন পারেন এমন গনগনে সূর্যের দিনে নিজেকে সূর্যের আলো থেকে আড়াল করে রাখতে? আঁধির ক্যাসেট আমার ভিডিও লাইব্রেরিতে আছে। আমি অন্তত ৫০ বার ছবিটা দেখেছি। যতবার দেখি, ততবারই আমার একটা কথা মনে হয়েছে, কেন তিনি নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে দিলেন?’
‘আমাকে টাচ করবে না!’ সপ্তপদী সিনেমার সেই সংলাপ অনেকেরই মনে থাকবে। রিনা ব্রাউনের সেই সংলাপ যেন তাঁর জীবনের অংশ হয়ে ছিল। যুগের পর যুগ, কেউ ছুঁতে পারল না তাঁকে! ১৯৭৮ সালে প্রণয়পাশায় অভিনয়ের পর থেকেই তিনি আড়ালে চলে গেলেন ধীরে ধীরে। সুচিত্রা একজীবনে তৈরি করেছেন একের পর এক রূপকথা। সে রূপকথা হয়তো লেখা হচ্ছে এখনো।
 

  • নিউজ ভিউ ৫৭৬