অপরাধ সূত্র :
রাজধানীসহ সারাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের তীব্র সংকট চলছে। সরবরাহ গত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিচে নেমে গেছে। ফলে দিনের সিংহভাগ সময়ে পাইপলাইনে সংযুক্ত গ্যাসের চুলা একদম জ্বলছে না কিংবা নিভু নিভু জ্বলছে। শিল্পকারখানায় উৎপাদন অর্ধেক কমে গেছে। দৈনিক প্রায় ৪১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস চাহিদার বিপরীতে সব বিতরণ কোম্পানিগুলো মিলে গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাস সরবরাহ করছে ২৫০-২৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। অর্থাৎ চাহিদার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি সরবরাহ ঘাটতি থাকছে।
চাহিদা বৃদ্ধির বিপরীতে স্থানীয় উৎপাদন না বাড়া, এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি কমে যাওয়া এবং গ্রিড পাইপলাইন থেকে গ্যাস চুরি হওয়ায় ঘাটতি-সংকট বেড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, শিগগিরই এ ঘাটতি দূর হবে না। কারণ-বিদ্যমান মজুদ হওয়া গ্যাস থেকে দৈনিক উৎপাদন কিছুটা বাড়ানো সম্ভব হলেও খুব বেশি বৃদ্ধি করা যাবে না। স্থানীয় গ্যাস পাওয়ার অনেক সম্ভাবনা থাকলেও তা অনুসন্ধান করে উৎপাদনে নিয়ে আসতে তিন বছর লেগে যাবে। আর ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমতে থাকায় অর্থনীতিতে সংকট তৈরি হয়েছে। তাই বর্তমানে যে হারে বা পরিমাণে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে তার চেয়ে বেশি এলএনজি আগামী এক বছরে আমদানি করা কঠিন হবে। সব মিলিয়ে ২০২৬ সাল নাগাদ গ্যাস ঘাটতি থাকবে। তবে চলতি বছরের শেষ ভাগ বা আগামী বছর থেকে ধাপে ধাপে ঘাটতির পরিমাণ কমবে বলে আশা করছেন তারা।
বিদ্যমান গ্যাস ঘাটতি বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, বর্তমান গ্যাস সংকট সাময়িক। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় বর্তমানে যে গ্যাস সংকট চলছে, আগামী মার্চে রোজার আগেই তা কমবে। তিনি বলেন, আমরা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের একটা টাইমলাইন ঠিক করে ফেলেছি। ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ থাকবে। এখন আমরা মাত্র ২০ শতাংশ গ্যাস বিদেশ থেকে আমদানি করি। ৮০ শতাংশ নিজস্ব গ্যাস ব্যবহার করছি। এই হারটা ধরে রাখতে চাই। আমদানির গ্যাসের অবস্থাটা খুব বেশি বড় করতে চাই না।
এ বছরই প্রতি মাসে বিদ্যুতের দাম ডায়নামিক পদ্ধতিতে নির্ধারণ করা হবে। অর্থাৎ উৎপাদন খরচ বা বিশ্ব বাজারে জ্বালানির মূল্য যেমন থাকবে সে হারে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা হবে। এরপর তেল ও গ্যাসের দামও একই পদ্ধতিতে নির্ধারণ করা হবে বলে প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন। একইসঙ্গে বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে অর্থের জোগান নিয়ে আগামী সপ্তাহে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হতে পারে বলে নসরুল হামিদ জানান।
পেট্রোবাংলার এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, শীতে সাধারণত বিদ্যুতের চাহিদা কমে যায়। তখন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ কমিয়ে আবাসিক ও শিল্পে বাড়ানো হয়। দেশজ উৎপাদন এবং এলএনজি আমদানি কমে যাওয়ায় এ বছর সেটি সম্ভব হচ্ছে না। দুইটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের মধ্যে একটি এখন বন্ধ আছে। বন্ধ থাকাটিতে পরিচালন শুরু হওয়ার পরে বর্তমানে চালু থাকাটি আবার কিছু সময় রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরবরাহ বন্ধ রাখবে। তবে রমজানের আগে দুটিই চালু থাকবে।
ঢাকার কয়েকটি এলাকায় তীব্র গ্যাস সংকট প্রসঙ্গে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির এক কর্মকর্তা বলেন, কিছু এলাকায় গ্যাস চুরি হচ্ছে। আর কিছু এলাকায় পুরনো পাইপলাইনের কারণে গ্যাসের উপজাত জমে লাইন সরু হয়ে গেছে। আবার কম সরবরাহের কারণে বিতরণ এলাকার শেষ দিকের বা লেজের গ্রাহকরাও সরবরাহ কম পাচ্ছেন। তাই নির্দিষ্ট কিছু এলাকাতে সংকট প্রকট।
সাভারে পোশাক কারখানার এক মালিক জানান, গ্যাস সংকটের কারণে তার একটি কারখানা পুরোপুরি বন্ধ। আরেক কারখানায় উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে। নারায়ণগঞ্জের একটি কারখানার মহাব্যবস্থাপক জানান, গ্যাস সংকটে তাদের উৎপাদন তিন ভাগের এক ভাগ কমে গেছে। কিছু কারখানা অসদুপায়ে গ্যাস নেওয়ায় অনেকে ন্যায্য গ্যাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি। আশুলিয়ার এক কারখানা মালিক জানান, গ্যাস সংকটের কারণে কার্যাদেশ কমে গেছে। তিনি প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কর্মী ছাঁটাই করেছেন গত এক বছরে।
সম্প্রতি প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্ট ২০২৪-এর গবেষণায় অংশ নেওয়া ৭০টি বাংলাদেশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান জ্বালানি সরবরাহের ঘাটতিকে অর্থনীতি ও তাদের ব্যবসার জন্য এক নম্বর হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেছে।
এদিকে রাজধানীর রমনায় সিদ্ধেশ্বরীর বাসিন্দা ফারজানা জামান জানান, তার বাসায় সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না। বিকাল থেকে ভোর পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ থাকলেও চাপ কম থাকে। জুরাইনের মুরাদপুরে সোহেল আরমান জানান, তার এলাকায় সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত কম চাপে গ্যাস থাকে। নিভু নিভু আগুনে রান্নার কাজ করতে হয়। অনেক সময় তা-ও হয় না। ফলে ইলেক্ট্রিক চুলায় রান্না করতে হয় প্রতিদিনই। এতে বাড়তি খরচ যোগ হয়েছে, সংসারে যা তার জন্য চাপ তৈরি করেছে। গ্যাস বিল দিয়েও গ্যাস না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।